যাহারা দাঁড়াইয়া, বসিয়া ও শুইয়া আলাহর স্মরণ করে এবং আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে ও বলে, ‘হে আমাদের প্রভুপালক! তুমি ইহা নিরর্থক সৃষ্টি কর নাই, তুমি পবিত্র, তুমি আমাদিগকে অগ্নিশাস্তি হইতে রক্ষা কর
— সুরা আলে ইমরান আয়াত ১৯১



যে ব্যক্তি জান্নাতের বাগানে পরিভ্রমণ করতে চায়, সে যেনো আলাহর জিকির অত্যধিক পরিমাণে করে
— হাদিসটি হজরত মুয়াজ থেকে বর্ণনা করেছেন ইবনে আবী শায়বা এবং তিবরানী


হজরত আলী রা. বলেছেন, রসুলে পাক স. এরশাদ করেছেন,
 তাফাক্কুরের মতো কোনো ইবাদত নেই।


 হজরত আবু হোরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন, রসুল স. বলেছেন, এক ব্যক্তি রাতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো বিস্ময়ঘেরা নক্ষত্রমন্ডলে। সে অভিভূত হলো এবং সাক্ষ্য দিলো, নিশ্চয়ই আমার প্রভূপালক সত্য। আমার স্রষ্টা সত্য। হে আমার আলাহ্! তুমি দয়া করে আমাকে মার্জনা করো। আলাহপাক তার প্রতি রহমত বর্ষণ করলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিলেন।
— আবু শায়েখ, ইবনে হাব্বান, সা’লাবী


হাসান বসরী র. বলেছেন, উচ্চঃস্বরের দোয়া ও নিম্নরের দোয়ার মধ্যে সত্তর হাজার গুণ পার্থক্য রয়েছে। প্রথম যুগের মুসলমানগণ দীর্ঘ সময় ধরে দোয়া করতেন। তাঁদের ওই দোয়ার সামান্য আওয়াজও শোনা যেতো না। শুধু শোনা যেতো ওষ্ঠ সঞ্চালনের শব্দ। কেননা আলাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন―

 তোমরা বিনীতভাবে এবং গোপনে তোমাদের প্রভুপালককে ডাক।
— সুরা আ’রাফ, আয়াত ৫৫

নবী জাকারিয়া সম্পর্কে অন্যত্র এরশাদ করেছেন―

 যখন সে তাহার প্রভুপালককে আহবান করিয়াছিল নিভৃতে।
— সুরা মার্‌য়াম, আয়াত ৩

 হজরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস বর্ণনা করেছেন, রসুল স. বলেছেন, উত্তম জিকির হচ্ছে জিকরে খফি (নীরব জিকির) এবং উত্তম জীবিকা হচ্ছে ঐ জীবিকা, যা ন্যূনতম সামর্থের অন্তর্ভূত।
— আহ্‌মদ, ইবনে হাব্বান, বায়হাকী

 হজরত আবু মুসা আশআরী বর্ণনা করেছেন, খয়বর যুদ্ধের সময় একটি প্রান্তর অতিক্রমকালে মুসলিম সৈন্যরা উচ্চঃস্বরে তক্‌বীর উচ্চারণ করেছিলেন। রসুলেপাক স. তখন বলেছিলেন, শান্ত হও। তোমরা কোনো অনুপস্থিত স্বত্বা তো আহবান করছো না তোমরা ওই সত্তাকে ডাকছো, যিনি সর্বশ্রোতা এবং নিকটতম।




যাহারা বিশ্বাস করে এবং আলাহর স্মরণে যাহাদের চিত্ত প্রশান্ত হয়; জানিয়া রাখ, আলাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়।
— সুরা রা’দ, আয়াত ২৮

রসুলেপাক স. বলেছেন, মানুষের অন্তঃকরণে (ক্বলবে) রয়েছে দুটি প্রকোষ্ঠ। একটিতে থাকে ফেরেশতা এবং অপরটিতে থাকে শয়তান। অন্তরে জিকির উত্থিত হলে শয়তান পালিয়ে যায়। আর জিকির না থাকলে শয়তান ক্বলবে অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয় তার চিন্ত। এভাবেই সে মানুষকে প্ররোচিত করে।

‘মুনসিফ’ গ্রন্থে হজরত আবদুলাহ ইবনে শাকীক থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইবনে শায়বা এবং হজরত ইবনে আব্বাস থেকে মারফুরূপে প্রলম্বিত সূত্র সহযোগে বর্ণনা করেছেন বোখারী।

হজরত আনাস রা. থেকে বাগবীও এই হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনার সাথে এই উক্তিটিও রয়েছে যে,

 হজরত আনাস বলেছেন, নিজের পাঁচটি আঙ্গুল গণনা করার মতো স্পষ্টরূপে এই হাদিসটি আমি রসুলুল্লাহর কাছ থেকে শুনেছি।
হজরত আবদুলাহ ইবনে শাকীক রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসুলেপাক স. এরশাদ করেছেন,

 মানুষের অন্তর দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। এক কক্ষে থাকে ফেরেশতা, অপর কক্ষে থাকে শয়তান। যখন মানুষ আলাহপাকের জিকির করে তখন শয়তান তার কুঠুরী ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর যখন জিকির থেকে অমনোযোগী হয়, তখন শয়তান তার ঠোঁট অন্তরে প্রবেশ করিয়ে কুমন্ত্রণা দেয়।
— ইবনে আবী শায়বা


আবু শাইখ এবং দায়লামী ‘মসনদে ফিরদাউস’ গ্রন্থে জোবায়েরের মাধ্যমে তিনি জুহাকের মাধ্যমে এবং তিনি হজরত আবদুলাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, রসুলে করীম সলালাহু আলাইহি ওয়া সালাম ‘ফাজকুরূনী আজকুরকুম’ আয়াতের শানে এরশাদ করেছেন― আলাহপাক বলেন,

 হে বান্দাসকল! তোমরা আমাকে ইবাদতের মাধ্যমে স্মরণ করো। আমি মাগফিরাতসহ তোমাদেরকে স্মরণ করবো। অর্থাৎ তোমরা আমার ইবাদত করো; আমি তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবো।
হজরত আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসুলে আকরম স. বলেছেন,

 আলাহপাক বলেন― আমার বান্দা আমার প্রতি যে ধারণা পোষণ করে, আমি তার সেই ধারণার অনুকূল। সে যখন আমাকে স্মরণ করে, তখন আমিও তাকে স্মরণ করি। সে যদি কোনো অনুষ্ঠানে আমাকে স্মরণ করে, তবে আমিও তাকে স্মরণ করি অধিকতর উত্তম অনুষ্ঠানে। সে যদি আমাকে অন্তরে স্মরণ করে, তবে আমিও তাকে অন্তরে স্মরণ করি। সে যদি আমার দিকে অর্ধ হাত এগিয়ে আসে, তবে আমি এগিয়ে যাই একহাত। সে একহাত এলে আমি যাই দুই হাত। সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে, তবে আমি যাই দৌড়ে।
— বোখারী, মুসলিম


‘আক্বিমিস্ সলাতা লি জিকরি’ (নামাজ প্রতিষ্ঠা করো আমার স্মরণের জন্য)- সুরা ত্বহা, আয়াত ১৪।

তোমাদিগকে স্মরণ করিব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং কৃতঘ্ন হইও না
— সুরা বাকারা আয়াত , ১৫২

হজরত আনাস বর্ণনা করেছেন, অন্তিম যাত্রা কালে এক যুবকের শয্যাপাশে উপস্থিত হলেন রসুলেপাক স.। বললেন, তোমার মনের অবস্থা এখন কেমন?
যুবক বললো, আমি আলাহর ক্ষমার আশা রাখি আবার তাঁর ভয়ে আমি ভীতও। তিনি স. বললেন, পৃথিবী পরিত্যাগের প্রাক্কালে যার অন্তরের অবস্থা এরূপ হয়, আল্লাহ্‌ তাকে দান করেন তার কাম্যবস্তু এবং রক্ষা করেন ভয়ভীতি থেকে।

— তিরমিজি, ইবনে মাজা


হজরত ইবনে আব্বাসের বর্ণনায় এসেছে, শয়তান দলিত মথিত করতে থাকে মানুষের অন্তর। সে যখন জিকিরে রত হয়, তখন শয়তান পশ্চাদপসরণ করে, আর অমনোযোগী হলে অন্তরে ঢেলে দেয় কুমন্ত্রণা ।


উম্মত-জননী হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. থেকে আবু ইয়ালী বর্ণনা করেছেন, রসুল স. বলেছেন, সরব জিকির অপেক্ষা নীরব জিকির সত্তর হাজার গুণ অধিক মর্যাদাপূর্ণ। শেষ বিচারের দিন ফেরেশতারা যখন মানুষের আমলনামা উপস্থিত করবে, তখন আলাহ্‌পাক এক লোককে দেখিয়ে বলবেন, ভালো করে দ্যাখো আমার এই বান্দার কোনো পাপ পুণ্য লেখা বাদ পড়লো কিনা! ফেরেশতারা বলবে, আমরা যা কিছু জেনেছি, শুনেছি ও দেখেছি― সবকিছুই আমলনামায় লিখে নিয়েছি। কোনো কিছুই পরিত্যাগ করিনি। আলাহ্‌তায়ালা বলবেন, আমার এই বান্দার গোপন আমলও রয়েছে, যার কথা তোমরা জানো না। সেই আমল হচ্ছে জিক্‌রে খফি।



সশংকচিত্তে অনুচ্চস্বরে প্রত্যূষে ও সন্ধ্যায় স্মরণ করিবে এবং তুমি উদাসীন হইবে না
— সুরা আ’রাফ, আয়াত ২০৫।

ব্যাখ্যাঃ
হজরত ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, এই আয়াতে নামাজের ক্বেরাতের উচ্চারণসীমা নির্দেশ করা হয়েছে। ‘ওয়াজকুর রব্বাকা ফি নাফসিকা’ কথাটির মধ্যে উলেখিত ‘জিকির’ অর্থ নামাজের ক্বেরাত অর্থাৎ এখানে বলা হয়েছে নামাজের মধ্যে গোপনে, মনে মনে (জিহবা সঞ্চালনসহ) ক্বেরাত পাঠ করবে। ‘ওয়া দুনাল জাহরি মিনাল ক্বওলি’- এখানে আল জাহরি অর্থ প্রকাশ্য নামাজ (যে নামাজে সশব্দে ক্বেরাত পাঠ করতে হয়)। দুনাল জাহ্‌রি অর্থ অনুচ্চস্বরে। অর্থাৎ সুউচ্চ স্বরের চেয়ে কম আওয়াজে এবং নিঃশব্দ আওয়াজের চেয়ে কিছুটা উচ্চস্বরে। এরকম বলার উদ্দেশ্য এই যে- যে নামাজগুলোতে উচ্চস্বরে ক্বেরাত পাঠের বিধান আছে (মাগরিব, এশা, ফজর) সে নামাজগুলোতে অত্যন্ত স্পষ্ট উচ্চারণে কোরআন পাঠ কোরো, অতিরিক্ত চিৎকার কোরো না। বরং এমন শান্তভাবে মধুর স্বরে পড়ো, যেনো পশ্চাতের ব্যক্তিদের শুনতে কোনো অসুবিধা না হয়।


মুজাহিদ বলেছেন, জিকির করবে অন্তরে অন্তরে। এটাই এই আয়াতের বক্তব্য। প্রার্থনার মধ্যে থাকতে হবে বিনয় ও শংকা। উচ্চকন্ঠ হবে না। চিৎকার করে আলাহকে ডাকবে না। মনে মনে দোয়া করলে হৃদয়ের বিশুদ্ধতা বৃদ্ধি পায়। আমি বলি, এখানে অনুচ্চস্বরে এবং মনে মনে কথা দুটোর মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক সংযোগ। কথা দুটোর মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে জিকরে জেহরী (অনুচ্চস্বরে জিকির) এবং জিকরে খফিকে (মনে মনে জিকিরকে)। ‘বিলগুদুব্যি’ অর্থ প্রত্যুষে, সকালে। আর ‘ওয়াল্ আস্লি’ অর্থ দিবসের শেষভাগ, সন্ধ্যা। সকাল ও সন্ধ্যা এ দুটো সময় যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তাই এই দুই সময়ে বিশেষভাবে জিকিরে নিমগ্ন থাকতে বলা হয়েছে। নতুবা জিকির তো করতে হবে সর্বক্ষণ। তাই শেষে বলা হয়েছে ‘ওয়ালা তাকুম্ মিনাল্ গফিলীন’ (এবং তুমি উদাসীন হয়ো না)। একথার অর্থ কোনো সময়ই আলাহর জিকির থেকে অমনোযোগী থেকো না।

আমি বলি, আয়াতের শুরুতে বলা হয়েছে ‘ওয়াজকুর্‌ রব্বাকা ফি নাফসিকা’। পরে বলা হয়েছে, ‘বিল গুদুব্যি ওয়াল আস্লি ওয়ালা তাকুম্ মিনাল্ গফিলীন’। এই বিবরণভঙ্গির মাধ্যমে এখানে জিকির বলে সব রকম জিকিরকেই বুঝানো হয়েছে। কোরআন পাঠসহ সকল জিকিরই এই নির্দেশনার অন্তর্ভুক্ত।



 অতঃপর যখন তোমরা হজ্জের অনুষ্ঠানাদি সমাপ্ত করিবে তখন আল্লাহ্‌কে এমনভাবে স্মরণ করিবে যেমন তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষগণকে স্মরণ করিতে, অথবা তদপেক্ষা অভিনিবেশ সহকারে।
— সুরা বাকারা, আয়াত ২০০





সুত্র: Sunnipedia.com






Top