সালাফে-সালেহীনের যুগেই আকিদার অঙ্গনে ভয়ংকর ফেতনা দু’টি জেকে বসেছিলো। ইমাম আবু হানিফা রহ. এসম্পর্কে বলেন,
“أتانا من المشرق رأيان خبيثان جهم معطل ومقاتل مشبه
অর্থাৎ পূর্ব দিক থেকে আমাদের নিকট দু’টি নিকৃষ্ট মতবাদ এসেছে। ১. জাহাম ইবনে সাফওয়ানের মতবাদ যে ছিলো মুয়াত্তিলা   (আল্লাহর গুণ অস্বীকারকারী )। ২. মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের মতবাদ যে ছিলো মুশাববিহা (আল্লাহর গুণাবলীকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য প্রদানকারী)। [তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬৪]
মুজাসসিমা ও মুশাববিহাদের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ ও আকিদা-বিশ্বাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে “দেহবাদী আকিদার স্বরূপ বিশ্লেষণ (১-৫) “পড়ুন।


ইস্তেওয়া সম্পর্কে সাদামাটা কিছু কথা:
=====================
১. আরবী ভাষায় ইস্তেওয়া শব্দের অনেক অর্থ রয়েছে। ইস্তেওয়ার সাথে অব্যয় পদ (ইলা, আলা) ইত্যাদির ব্যবহারের পার্থক্যের সাথে সাথে অর্থের পরিবর্তন হয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো, ইস্তেওয়া আলা এর অর্থ বিশ্লেষণ করা।
২. পবিত্র কুরআনের বিখ্যাত তাফসীরসমূহে “ইস্তেওয়া আলা” এর দু’টি অর্থ করা হয়েছে। ১. কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ২. মর্যাদাগতভাবে সমুন্নত হওয়া। ইস্তেওয়ার আরেকটি অর্থ হলো, পরিপূর্ণতায় পৌছানো।
৩. আমার ক্ষুদ্র তাহকীক অনুযায়ী, পৃথিবী বিখ্যাত কোন তাফসীরে পবিত্র কুরআনের সূরা ত্ব-হা বা অন্য আয়াতের ইস্তেওয়ার অর্থ বসা, সমাসীন হওয়া, অধিষ্ঠিত হওয়া, অধিষ্ঠান গ্রহণ করা ইত্যাদি অর্থ করা হয়নি। আরবী ভাষায় সমাসীন হওয়া বা বসার আরবী হলো, জালাসা (جلس), কায়াদা (قعد)। বিখ্যাত কোন তাফসীরে ইস্তেওয়ার এই বসার অর্থ করা হয়নি।
৪. আমরা এখানে ধারাবাহিকভাবে অনেক বিখ্যাত মুফাসসিরের বক্তব্য উল্লেখ করবো যারা তাদের তাফসীরসমূহে ইস্তেওয়ার অর্থ করেছেন, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
৫. ইস্তেওয়ার একটি ভ্রান্ত ও বাতিল অর্থ হলো, বসা বা সমাসীন হওয়া। আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে এধরনে বাতিল বিশ্বাস ইমানের জন্য ভয়ংকর। আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দেয়া অবশ্যই কুফুরী। সুতরাং এধরনের ইমান বিধ্বংসী বিশ্বাস থেকে দূরে থাকতে হবে। কুরআনের কোন বাংলা অনুবাদক ভুল করে বা না জেনে এধরনের অর্থ করে থাকতে পারেন। তবে কেউ যদি ইচ্ছা করে এধরনের বাতিল বিশ্বাস রাখে তবে সে অবশ্যই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত থেকে বের হয়ে ভ্রান্ত ফেরকা মুজাসসিমাদের অন্তুর্ভূক্ত হবে।
৬. আরবী ভাষার প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ ব্যবহারে সমাসীন বা বসার অর্থে কখনও ইস্তেওয়া ব্যবহৃত হয় না। বরং এর জন্য জালাসা (جلس), কায়াদা (قعد) ব্যবহৃত হয়। আরবী অভিধান অনুযায়ী ইস্তেওয়ার অর্থ বসা করাটাও অপ্রচলিত ও অপ্রসিদ্ধ ব্যবহার গ্রহণ করা হয়। অধিকাংশ অভিধানবিদ তাদের অভিধানে ইস্তেওয়ার এই অপ্রচলিত অর্থটি লেখেননি।
 ৭. সালাফে-সালেহীনের কারও থেকে বিশুদ্ধ বর্ণনায় ইস্তেওয়ার অর্থ বসা বা সমাসীন হওয়া পাওয়া যায় না। মূলত: ইস্তেওয়ার এই অর্থটি মুজাসসিমা ও কাররামিয়াদের সৃষ্টি।
৮. সালাফীদের বিখ্যাত ফতোয়ার সাইট ইসলাম ওয়েব এ বিষয়ে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করা হয়। তারা এর উত্তরে লিখেছেন,
وأما تفسيره بالجلوس فليس مشهورا ولا معروفا عنهم
” সালাফে-সালেহীন থেকে প্রসিদ্ধ বা পরিচিত কোন বর্ণনায় ইস্তেওয়ার শব্দটি বসা বা সমাসীন হওয়ার  অর্থে পাওয়া যায় না।”
ফতোয়ার লিংক:
http://fatwa.islamweb.net/fatwa/index.php?page=showfatwa&Option=FatwaId&Id=172147



বিখ্যাত মুফাসসিরগণের মতে ইস্তেওয়ার অর্থ:
========================
১. আবু আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াহইয়া ইবনুল মুবারক [মৃত: ২৩৭ হি:] এর তাফসীর:

বিখ্যাত ভাষাবিদ ও আরবী ব্যাকরণবিদ  আবু আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াহইয়া ইবনুল মুবারক [মৃত: ২৩৭ হি:]  তার ” গারিবুল কুরআন ও তাফসীরুহু” -তে লিখেছেন,
: الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى } [سورة طه:5] استوى: استولى” اهـ}
” সূরা ত্ব-হা এর পাঁচ নং আয়াত: দয়াময় আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। “ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো, ইস্তাওলা তথা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা”
[গারিবুল কুরআন ও তাফসীরুহু, পৃষ্ঠা.২৪৩, আলামুল কুতুব]

২.  ইবনে জারীর ত্ববারী রহ. [মৃত: ৩১০ হি:] এর তাফসীর:
=============================
ইমাম ইবনে জারীর ত্ববারী রহ. তার বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ “জামিউল বয়ান” এ ইস্তেওয়া শব্দের বিশ্লেষণ করেছেন। আরবী ভাষায় ইস্তেওয়া শব্দের বিভিন্ন ব্যাবহার সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ইবনে জারীর ত্ববারী রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী আরবী ভাষায় ইস্তেওয়ার একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হলো ইস্তাউলা বা কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। আরবী ভাষায় ইস্তেওয়ার এর অনুগামী অব্যয়ের কারণে এর অর্থের পবির্তন হয়। ইস্তেওয়ার অনুগামী অব্যয় পদ যখন “ইলা” (إلي) হয়, তখন তিনি এর অর্থ গ্রহণ করেছেন সমুন্নত হওয়া বা উঁচু হওয়া। তিনি স্পষ্টভাষায় লিখেছেন, সমুন্নত হওয়া দ্বারা স্থান বা অবস্থানগত সমুন্নত বা উচু হওয়া উদ্দেশ্য নয়। বরং সমুন্নত হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য মর্য়াদা, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের দিক থেকে সমুন্নত হওয়া। এ বক্তব্যের মাধ্যমে ইমাম ত্ববারী রহ, দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা স্থান ও দিক থেকে  পবিত্র। তিনি উচু বা সমুন্নত হওয়ার দ্বারা কখনও এটি উদ্দেশ্য নয় যে, তিনি স্থানগত দিক থেকে উচু বা সমুন্নত হয়েছেন। বরং আল্লাহর সমুন্নত হওযার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মর্যাদাগত সমুন্নত হওয়া।  ইবনে জারীর ত্ববারী রহ. সূরা বাকারার ২৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
علا عليها علو ملك وسلطان لا علو انتقال وزوال.اهـ “তিনি  নিজের কর্তৃত্ব, মালিকানা ও ক্ষমতার দিক থেকে আসমান সমূহের উপর সমুন্নত হয়েছেন। সমুন্নত হওয়া হওয়া দ্বার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া কিংবা এক জায়গা থেকে সরে যাওয়া উদ্দেশ্য নয়।”
[ তাফসীরে ত্ববারী, খ.১, পৃ.৪২৯-৪৩০, তাহকীক, আহমাদ শাকের]

মূল বইয়ের ডাউনলোড লিংক:
https://archive.org/details/TafsirTabariShakir



এছাড়াও ইমাম ত্ববারী রহ. স্পষ্টভাষায় তার তারীখে ত্ববারীর ভূমিকায় আল্লাহ তায়ালাকে দিক থেকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন। ইমাম ত্ববারী রহ. তারীখে ত্ববারীর ভূমিকায় বলেন,
” لاتحيط به الأوهام ولا تحويه الأقطار و لا تدركه الأبصار “
অর্থাৎ কারও ধ্যান-ধারণা আল্লাহকে পরিব্যাপ্ত করতে পারে না, কোন দিক আল্লাহকে বেষ্টন করে না, কোন চোখ তাকে অবলোকন করতে পারে না।”
[তারীখে ত্ববারী, খ.১, পৃ.৩, তাহকীক, মুহাম্মাদ আবুল ফজল ইব্রাহিম]

#মূল কিতাবের ডাউনলোড লিংক:
http://www.waqfeya.com/book.php?bid=8541



সুতরাং ইবনে জারীর ত্ববারী রহ. এর নিকট আল্লাহ তায়ালা বান্দার ধারণা থেকে উর্ধ্বে। মানুষ আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে যেসব কল্পনা করে তিনি তা থেকে পবিত্র। আল্লাহ তায়ালা সমস্ত দিক থেকে পবিত্র। কোন দিকেই আল্লাহ তায়ালা অবস্থান করেন না। কোন দিকই আল্লাহ তায়ালাকে পরিবেষ্টন করে না। তিনি স্থান ও দিক থেকে পবিত্র।   দুনিয়াতে চর্মচোখে আল্লাহ তায়ালাকে দেখা অসম্ভব।
3. ইমাম আবু ইসহাক ঝুজাজ রহ.[মৃত: ৩১১] এর তাফসীর:
====================================
ইমাম ঝুজায রহ. আরবী ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ ব্যাকরণবিদ ও ভাষাবিদ। ইমাম যাহাবী [মৃত ৭৪৮ হি:] তার সম্পর্কে বলেন, “তিনি তার সময়ের শ্রেষ্ঠ ব্যাকরণবিদ ছিলেন” [সিয়ারু আ'লামিন নুবালা, খ.১৪, পৃ.৩৬০]। ইমাম ঝুজায রহ. তাঁর “মায়ানিল কুরআন ও ই’রাবুহু” নামক কিতাবে লিখেছেন,
وقالوا: معنى استوى استولى اهـ
অর্থাৎ ” ইস্তেওয়ার অর্থ হলো ইস্তাউলা বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা ”
[মায়ানিল কুরআন ও ই'রাবুহু, খ.৩, পৃ.৩৫০, তাহকীক, ড. আব্দুল জলীল আব্দুহ]
#মূল কিতাবের ডাউনলোড লিংক:
http://www.waqfeya.com/book.php?bid=1404



৪. ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদি হানাফী রহ. [মৃত:৩৩৩ হি] এর বক্তব্য:
====================================

আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বিখ্যাত ইমাম ও যুগশ্রেষ্ঠ আকিদাবিশারদ ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদী তার যুগশ্রেষ্ঠ তাফসীর “তা’বীলাতু আহলিস সুন্নাহ” নামক কিতাবে লিখেছেন, ইস্তেওয়ার একটি অর্থ হলো কর্তৃত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
তিনি সূরা ত্বহার ৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যায়  ইস্তেওয়ার আরো দু’টি অর্থ লিখেছেন। অর্থাৎ ক্ষমতা ও মর্যাগতভাবে সমুন্নত হওয়া। আরেকটি অর্থ হলো, আরশের মাধ্যমে সৃষ্টিকে পরিপূর্ণতায় পৌছানো।
[তা'বীলাতু আহলিস সুন্নাহ, খ.৭ পৃ.২৬৭, তাহকীক, ড.মাজদী বাছলুম।]

# মূল কিতাবের ডাউনলোড লিংক:
https://archive.org/details/Tafsirmaturidi



৫. আবুল কাসেম আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক আয-ঝুযাযী রহ. [মৃত:৩৪০ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম আবুল কাসেম আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক রহ. বিখ্যাত একজন আরবী ভাষাবিদ ও ব্যাকরণবিদ ছিলেন। ইমাম যাহাবী তার সম্পর্কে বলেন,
“شيخ العربية وتلميذ العلامة أبي إسحاق إبراهيم بن السري الزجاج، وهو منسوب إليه”اهـ
” ইমাম আবুল কাসেম আরবী ভাষার শায়খ ছিলেন এবং তিনি ইমাম ঝুযাযের বিখ্যাত ছাত্র ছিলেন।” [সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.১৫, পৃ.৪৭৫।
ইমাম আবুল কাসেম ঝুযাযী রহ. তার “ইশতেকাকু আসমাইল্লাহ”-তে লিখেছেন,
” আল্লাহর দু’টি গুণগত নাম হলো আলী (علي) ও আ’লী (عالي)। এর অর্থ হলো, কোন কিছুর উপর ক্ষমতাধর বা কর্তৃত্ববান। আরবরা বলে থাকে, علا فلان فلانا অর্থাৎ অমুক অন্যের উপর কর্তৃত্ববান বা ক্ষমতাশীল হয়েছে। যেমন কবি বলেছেন,

فلما عَلَونا واستوينا عليهم ** تركناهم صرعى لنسر وكاسرِ
” আমরা যখন তাদের উপর ক্ষমতাশালী হলাম এবং তাদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলাম, আমরা তাদের মৃতদেহ গুলোকে শকুন ও বাজপাখীর জন্য রেখে দিলাম”

[ইশতেকাকু আসমাইল্লাহ, আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক ঝুযাজী রহ. , পৃ.১০৯, তাহকীক,  আব্দু রব্বিল হুসাইন মোবারক]

# মূল কিতাবের ডাউনলোড লিংক:
http://www.waqfeya.com/book.php?bid=1862






 
Top