পবিত্র কুরআনের সূরা ত্বহার ৫ নং আযাতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى
“দয়াময় আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন”।


এই আয়াত ব্যবহার করে বাতিল আকিদার কিছু লোক বলে থাকে, আল্লাহ তায়ালা আরশে বসে আছেন নাউযুবিল্লাহ। এধরনের বাতিল বক্তব্যের সাথে এই আয়াতের কোন দূরতমত সম্পর্ক নেই। যারা এধরনের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা করে মানুষের আকিদা নষ্ট করার চেষ্টা করছেে তাদের ব্যপারে সচেতন হওয়া আবশ্যক। আমরা ইস্তেওয়া শব্দের অর্থের উপর সংক্ষিপ্ত কিছু পর্যালোচনা বিগত পর্বে উল্লেখ করেছি। আগ্রহী পাঠকগণ প্রথম পর্ব দেখতে পারেন। আমরা এই ধারাহাবিক আলোচনায় ইনশাআল্লাহ অনেক মুফাসসিরিন গনের বক্তব্য উল্লেখ করবো, যারা প্রত্যেকেই ইস্তেওয়া শব্দের সঠিক অর্থ উল্লেখ করেছেন।




৬. বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ত্ববরানী (মৃত:৩৬০ হি:) তার তাফসীরে কাবীরে বলেন,
والاستواء: الاستيلاء، ولم يـزل الله سبحانه مستوليا على الأشياء كلها، إلا أن تخصيص العرش لتعظيم شأنه
অর্থাৎ ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ, ইস্তিলা বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তায়ালা সদা-সর্বদা সমস্ত বস্তুর উপর নিজের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন। তবে এখানে বিশেষভাবে আরশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আরশের গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রকাশের উদ্দেশ্যে।
[আত-তাফসীরুল কাবীর, ইমাম ত্ববরানী, খ.৩, পৃ.৩৭২]

৭. ইমাম আবু বকর জাসসাস রহ. [মৃত:৩৭০ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম আবু বকর জাসসাস তার বিখ্যাত কিতাব আহকামুল কুরআনে লিখেছেন,
“: قوله تعالى: {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى } [سورة طه:5] قال الحسن: استوى بلطفه وتدبيره، وقيل: استولى.اه
অর্থাৎ মহান আল্লাহর বাণী: দয়াময় আল্লাহ আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন।(সূরা ত্ব-হা, আয়াত নং৫)। ইমাম হাসান বলেন, তিনি নিজের দয়া, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার পূর্ণতা দান করেছেন। এবং কারও মতে ইস্তেওয়ার অর্থ হলো, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
[আহকামুল কুরআন, খ.৩, পৃ.৩২৫]
৮. ইমাম আবুল লায়স সামরকন্দী রহ(মৃত:৩৭৫ হি:) এর তাফসীর:
ইমাম আবুল লায়স বলেন,
ويقال استوى استولى
অর্থাৎ ইস্তেওয়ার আরেকটি অর্থ বলা হয়, ইস্তাওলা বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
[তাফসীরে সমরকন্দী বা বাহরুল উলুম, খ.২, পৃ.৩৭৬]

৯. ইমাম আবু বকর ইবনে ফাউরক [মৃত:৪০৬ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম আবু বকর ইবনে ফাউরক তার মুশকিলুল হাদীস কিতাবে বলেন,
: لأن استواءه على العرش سبحانه ليس على معنى التمكن والاستقرار، بل هو على معنى العلو بالقهر والتدبير وارتفاع الدرجة بالصفة، على الوجه الذي يقتضي مباينة الخلق. اهـ
অর্থাৎ আরশে র উপর আল্লাহর ইস্তেওয়া দ্বারা কখনও এটি উদ্দেশ্য নয় যে তিনি আরশের উপর অবস্থান করেন বা আরশের উপর স্থির হয়েছেন। বরং কর্তৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতার দ্বারা সমুন্নত হওয়া এবং গুণগত মর্যাদা উদ্দেশ্য। কেননা আল্লাহ তায়ালা সমস্ত সৃষ্টি থেকে পৃথক ও ভিন্ন।
[মুশকিলুল হাদীস, পৃ.২২৯]

১০ইমাম আবু মনসুর নাইসাপুরী রহ. [মৃত: ৪২১] এর বক্তব্য:
ইমাম আবু মনসুর নাইসাপুরী রহ. বলেন ,
إن كثيرا من متأخري أصحابنا ذهبوا إلى أن الاستواء هو القهر والغلبة
আমাদের পরবর্তী অনেক আলেম এমত গ্রহণ করেছেন যে, ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো, কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও প্রতাপ।
[আল-আসমা ওয়াস সিফাত, পৃ.৩৭২]

১১. ইমাম আবু মুহাম্মাদ জুয়াইনী (মৃত: ৪৩৮ হি:) এর বক্তব্য:
ইমাম জুয়াইনী রহ. বলেন,
“ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ পূর্ণক্ষমতা দ্বারা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেষ্টণ করা। এর দ্বারা কখনও আল্লাহর স্থান, দিক, অবস্থানের জায়গা কিংবা সীমা উদ্দশ্যে নয়।”
[ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন, খ.২, পৃ.১১০]



১২.ইমাম আবুল হাসান মাওয়ারদী রহ. [মৃত: ৪৫০ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম আবুল হাসান মাওয়ারদী রহ. বলেন,
: { ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ } [سورة الأعراف: 54]: فيه قولان: …والثاني: استولى على العرش كما قال الشاعر :
قد استوى بِشْرٌ على العِراقِ ** من غير سَيفٍ ودمٍ مُهراقِ”اهــ

অর্থাৎ পবিত্র কুরআনের বাণী: অত:পর আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। [সূরা আ'রাফ, ৫৪]। ইমাম মাওযারদী বলেন, ইস্তেওয়া শব্দের দু’টি অর্থ রয়েছে। …। দ্বিতীয় অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেমন কবি বলেছেন,
বিশর ইরাকের উপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। কোন তরবারী চালনা কিংবা রক্তপাত ব্যতীতই।
[আন-নুকাতু ওয়াল উয়ূন, খ.২, পৃ.২২৯]

১৩. ইমাম আবু বকর বাইহাকী রহ. [মৃত: ৪৫৮ হি:] এর বক্তব্য:
ইমাম বাইহাকী রহ. বলেন
أن الاستواء هو القهر والغلبة، ومعناه أن الرحمن غلب العرش وقهره، وفائدته الإخبار عن قهره مملوكاته، وأنها لم تقهره، وإنما خص العرش بالذكر لأنه أعظم المملوكات، فنبه بالأعلى على الأدنى، قال: والاستواء بمعنى القهر والغلبة شائع في اللغة، كما يقال استوى فلان على الناحية إذا غلب أهلها، وقال الشاعر في بشر بن مروان: قد استوى بشر على العراق * * من غير سيف ودم مهراق. اهـ يريد أنه غلب أهله من غير محاربة

অর্থাৎ ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো, কর্তৃত্ব ও ক্ণমতা বজায় রাখা। এর অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং একে নিজের ক্ণমতার অধীন করেছেন। আয়াতে বিষয়টি উল্লেখের বিশেষ ফায়দা হলো, আল্লাহ তায়ালা এর মাধ্যমে জানিয়েছেন, আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর ক্ণমতার অধীন। এবং তিনি কারও অধীন নন। আর এক্ণেত্রে বিশেষভাবে আরশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এজন্য যে, আরশ আল্লাহর সবচেয়ে বড় সৃষ্টি। সুতরাং তিনি সবচেয়ে বড় সৃষ্টির কথা উল্লেখ করে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, সমস্ত ছোট সৃষ্টিও আল্লাহর ক্ণমতা ও কর্তৃত্বের অধীন। কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অর্থে ইস্তেওয়া শব্দটির ব্যবহার আরবী ভাষায় ব্যাপক পরিচিত। যেমন বলা হয়, , অমুক উক্ত অন্চলের উপর ইস্তেওয়া করেছে বা নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছে। বিশর ইবনে মারওয়ান সম্পর্কে কবি বলেন, বিশর ইরাকের উপর নিজের ক্ণমতা প্রতিষ্ঠা করেছে। কোন রক্তপাত ও যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়াই। এখানে কবি
উদ্দেশ্য নিয়েছেন, কোন যুদ্ধ ছাড়া বিশর ইরাকের মানুষের উপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
[আল-আসমা ওয়াস সিফাত, পৃ.৪১২]



১৪. ইমাম আবুল হাসান নাইসাপুরী রহ. [মৃত: ৪৬৮ হি:]এর তাফসীর:

ইমাম আবুল হাসান নাইসাপুরী রহ. তার আল-ওজীয নামক তাফসীরে লিখেছেন,
{ اسْتَوَى } أي استولى.اهـ
ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো ইস্তাউলা বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
১৫. ইমাম আবু ইসহাক শিরাজী রহ. [মৃত: ৪৭৬ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম আবু ইসহাক শিরাজী রহ. বলেন,
الاستواء بمعنى الاستيلاء، استوى على العرش أي استولى عليه، يقال استوى فلان على الملك أي استولى عليه

অর্থাৎ ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ইস্তাওয়া আলাল আরশ এর অর্থ হলো, আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। আরবী ভাষায় বলা হয়, অমুক ব্যক্তি দেশে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
[আল-ওয়াজীয, খ.২, পৃ.১৫]



 
Top